গাদীর-এ খুমের খোতবা
(خطابة غدير)
পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে
প্রথম অংশ
১. সব প্রশংসা মহান আল্লাহর যিনি এক অদ্বিতীয় বলেই সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ, অনন্য ও অতুলনীয় হয়েও (সবার) নিকটবর্তী, স্বীয় আধিপত্য ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে উচ্চ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী, স্বীয় শক্তি ও ক্ষমতার ক্ষেত্রে বিশাল ও মহান, নিজ অবস্থানে থেকেও যিনি সকল বস্তু ও পদার্থকে জ্ঞানগত ভাবে পরিবেষ্টিত করেছেন ও ঘিরে রেখেছেন, গোটা সৃষ্টি জগৎকেই যিনি স্বীয় ক্ষমতা (কুদরত) ও অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ (বুরহান) দিয়ে বশীভূত ও পদানত করেছেন, যিনি এখনও প্রশংসিত আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন প্রশংসনীয়, উচ্চ মর্যাদা বান সত্বা যিনি কখনো ধ্বংস ও বিলুপ্ত হবেন না, যিনি সৃষ্টির সূচনাকারী এবং (সৃষ্টিকুল ধ্বংস ও লুপ্ত হওয়ার পর সেগুলো) পুনঃ সৃষ্টিকারী এবং যার কাছে প্রত্যাবর্তন করবে ও ফিরে যাবে সব কিছু। মহান আল্লাহ্ ব্যতীত যা কিছু আছে সেগুলো সবই হচ্ছে তাঁরই সৃষ্ট (মাখলূক)।
২. মহান আল্লাহ পুরু (স্থূল, গাঢ় ঘন ) বস্তু ও পদার্থ সমূহেরও স্রষ্টা ও উদ্ভাবক, বিস্তৃত বস্তুসমূহের বিস্তৃতি দানকারী, জমিন ও আসমান সমূহের উপর মহাপরাক্রমশালী (কর্তৃত্বশীল), মহাপবিত্র-মহা প্রশংসিত, ফেরেশতাকুল ও রূহের (প্রধান ফেরেশতা বা ফেরেশতাদের সর্দার ) প্রভু, যাদেরকে তিনি সৃষ্টি করেছেন তাদের সবার উপর তিনি কৃপা প্রদর্শনকারী, যাদেরকে তিনি প্রতিপালন করেছেন তাদের সবার উপর তিনি করুণা প্রদর্শনকারী, তিনি সকল চোখকে দেখেন তবে চক্ষু সমূহ তাঁকে দেখে না । (মহান আল্লাহ) মহানুভব দানশীল, সহিষ্ণু ও ধৈর্য্যশীল; তাঁর রহমত (দয়া) সব কিছু ব্যাপ্ত করেছে ও ঘিরে রেখেছে, নিজ নেয়ামত দিয়ে তিনি সৃষ্টিকুলের উপকার সাধন ও তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন; তিনি প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষেত্রে ত্বরা করেন না এবং তারা (বান্দাগণ) যে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য তাদের জন্য সে শাস্তি তিনি ত্বরান্বিত করেন না।
৩. তিনি সকল রহস্য ও ভেদ অনুধাবন করেছেন; অন্তর সমূহ সম্পর্কে জ্ঞাত; গোপণ বিষয়াদি তাঁর কাছে লুক্কায়িত থাকে নি এবং তাঁর কাছে সকল লুক্কায়িত বিষয়ও অস্পষ্ট ও অনুৎঘাটিত থাকে নি । সকল বস্তুনিচয়কে তিনি পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন; প্রতিটি বস্তু ও বিষয়ের উপর রয়েছে তাঁরই প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব; সকল বস্তুতে রয়েছে তাঁরই শক্তি এবং সব কিছুর উপর রয়েছে তাঁরই ক্ষমতা; কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয়; ঐ সময়ও তিনি বস্তু ও পদার্থের স্রষ্টা ও উদ্ভাবক যখন কোনো বস্তু ও পদার্থই বিদ্যমান ছিল না; তিনি চিরস্থায়ী, চিরঞ্জীব ও সদা ন্যায় পরায়ণ; তিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ (উপাস্য) নেই ; তিনিই মহা ক্ষমতাবান প্রজ্ঞাময়।
৪. চক্ষুসমূহ কর্তৃক তাঁকে দর্শন ও অবলোকন করার পর্যায় হতে বহু উর্ধ্বৈ তিনি বরং তিনি চক্ষুসমূহ অনুধাবন করেন (চক্ষু সমূহ তাঁকে দেখে না বরং তিনি তাদেরকে দেখেন ও অনুধাবন করেন); তিনি অতিশয় সূক্ষ্ণদর্শী, সব বিষয়ে ওয়াকিফহাল। কোনো সত্বাই পর্যবেক্ষণ ও দর্শন করার মাধ্যমে তাঁর বর্ণনা প্রদান করতে সক্ষম নয়। আর কেউই পায় নি যে গোপণ ও প্রকাশ্যে তিনি কেমন যতটুকু তিনি নিজ সম্পর্কে বলেছেন কেবল ততটুকু ব্যতীত।
৫. আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তিনিই মহান আল্লাহ যার পবিত্রতা সকল যুগকে পরিপূর্ণ করেছে , যার নূর (দ্যুতি ও আলো) অনাদি অনন্ত সময়কালকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে , যিনি তাঁর নিজ আদেশ কোনো পরামর্শ দাতার পরামর্শ ব্যতিরেকেই কার্যকর করেন, নির্ধারণ ও অবধারিত করনের ক্ষেত্রে যার সাথে নেই কোনো শরীক এবং (বিশ্ব জগৎ) পরিচালনার ক্ষেত্রে যাকে কোনো সহায়তা ও সহযোগিতা করা হয় না।
৬. পূর্ব দৃষ্টান্ত ও উপমা ছাড়াই যা কিছু তিনি অভিনবরূপে সৃষ্টি ও তৈরি করেছেন তিনিই সেগুলোর রূপ ও স্বরূপ দান করেছেন; কারো কাছ থেকে কোনো সাহায্য সহায়তা ছাড়াই কোনো কষ্ট ব্যতিরেকে এবং পূর্ব পরিকল্পনা ও চিন্তা ব্যতীত যা সৃষ্টি করার আছে তা তিনি সৃষ্টি করেছেন; তিনি সেগুলো (সৃষ্টি কুল) সৃষ্টি ও উদ্ভাবন করেছেন বিধায় সেগুলো অস্তিত্ববান হয়েছে; তিনি সেগুলো সৃষ্টি করেছিলেন বিধায় সেগুলো স্পষ্ট প্রকাশিত হয়েছে ও অধিক বিশিষ্টতা লাভ করেছে ; তাই তিনিই মহান আল্লাহ যিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই ; একমাত্র তিনিই নির্মাণ ও সৃষ্টি কর্মে অতি সুনিপুণ ও সুদক্ষ, (সৃষ্টিকুলের উপর) অতি উত্তম অনুগ্রহ ও কৃপা প্রদর্শনকারী, পরম ন্যায়পরায়ণ যিনি কভু অন্যায় অত্যাচার করেন না এবং সবচেয়ে দয়ালু দানশীল যার কাছে প্রত্যাবর্তন করে ও ফিরে যায় সকল বিষয় ও বস্তু নিচয় ।
৭. আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তিনিই মহান আল্লাহ যার মহত্ত্বের কাছে হয়েছে সকল বস্তু (পুরো সৃষ্টি জগৎ) বিনয়ে অবনত, যার ইজ্জতের (মর্যাদা ও সম্মান) কাছে সকল বস্তু তুচ্ছ ও সামান্য, যার ক্ষমতার কাছে সবাই হয়েছে আত্মসমর্পিত এবং যার বিশাল মহান ভাবমূর্তির কাছে নতি স্বীকার করেছে ও বশীভূত হয়েছে সকল বস্তু (তাবৎ সৃষ্টিকুল) ।
৮. (মহান আল্লাহ ই) সকল রাজ্য ও রাজত্বের অধিপতি বাদশাহ, গ্রহ নক্ষত্র সমূহের কক্ষপথের আকার আকৃতি দান ও তা নির্ধারণ কারী, চন্দ্র ও সূর্য বশীভূত কারী; নির্দিষ্ট সময় কাল পর্যন্ত সব কিছুই আছে প্রবহমান ও গতিশীল; ‘তিনি রাত দিয়ে দিনকে ঢাকেন (আবৃত করেন) এবং রাতকে দিবা ভাগ দিয়ে আবৃত করেন’; [যুমার : ৫] আর রাতদিন দ্রুততার সাথে একে অপরের পশ্চাতে ধাবমান ও অন্বেষণ রত; [আরাফ : ৫৪] (মহান আল্লাহ) প্রত্যেক অবাধ্য (একগুঁয়ে ও অনমনীয়) প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্যক্তির দর্প ও শক্তি চূর্ণ বিচূর্ণকারী এবং প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের নিধনকারী।
৯. তাঁর নেই কোনো বিরোধী প্রতিপক্ষ, আর নেই কোনো সমকক্ষ শত্রুভাবাপন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী; তিনি এক অদ্বিতীয়, নিরাভাব স্বয়ংসম্পূর্ণ যিনি না জন্ম দিয়েছেন না জন্ম গ্রহণ করেছেন আর নেই কেউ তাঁর সমকক্ষ [ইখলাস : ৩-৪]; তিনি একমাত্র ইলাহ (উপাস্য), উচ্চ মর্যাদাশীল প্রভু; তিনি (সৃষ্টি জগতের) যা কিছু (সৃষ্টি ও বাস্তবায়নের) ইচ্ছা করেন তা বাস্তবায়ন ও সম্পন্ন করেনই; তিনি (তাশরীয়ী বা শারয়ী বিষয় যার বাস্তবায়ন বান্দার ইচ্ছাধীন তা বাস্তবায়নের) ইচ্ছা করেন অতঃপর (তা বান্দার ইচ্ছা ও ইখতিয়ার সাপেক্ষে) বাস্তবায়ন ও সম্পন্ন করেন; তিনি আছেন সর্ব জ্ঞাত ও সর্বজ্ঞ এবং সব কিছুর হিসাব রাখেন; তিনি মৃত্যু দেন (মৃত্যু ঘটান) এবং জীবন দান ও জীবিত করেন; তিনি দরিদ্র (ও কপর্দকহীন) করেন এবং তিনি সচ্ছল (অভাবহীন) ও ধনী করেন ; তিনি হাসান এবং তিনি কাঁদান; তিনি (প্রদান করা থেকে) বিরত থাকেন ও বারণ করেন এবং তিনি দেন; রাজত্ব একমাত্র তাঁরই এবং প্রশংসা একমাত্র তাঁরই; মঙ্গল ও কল্যাণ আছে কেবল তাঁরই হাতে এবং সব কিছুর উপর তিনি ক্ষমতাবান।
১০. তিনি রাতকে দিনের মধ্যে এবং দিনকে রাতের মাঝে প্রবিষ্ট করেন; [হাদিদ : ৬] তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই ; তিনি মহা পরাক্রমশালী পরম ক্ষমাশীল; তিনি প্রার্থনায় সাড়া দানকারী এবং মুক্ত হস্তে দানকারী; তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস সমূহের গণনাকারী (বান্দাদের ও প্রাণীসমূহের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের হিসাবও তার কাছে সংরক্ষিত আছে) এবং জিন ও মানব জাতির প্রভু যার কাছে কিছুই দুঃসাধ্য ও কঠিন নয়, যাকে ফরিয়াদ কারীর ফরিয়াদ ত্যক্ত বিরক্ত করে না, যাকে ক্লান্ত ও শ্রান্ত করে না জোরজবরদস্তি কারীদের জোরজবরদস্তি ও চাপ; যিনি সৎকর্মশীলদের সুরক্ষক, সফলকাম ব্যক্তিদের তৌফিক ও সাফল্য দানকারী, মুমিনদের মওলা ও গোটা নিখিল বিশ্বের প্রভু; যিনি সৃষ্টি জগতের প্রতিটি সৃষ্টির কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পাত্র ও সাধুবাদ পাওয়ার উপযুক্ত এবং প্রশংসিত হওয়ার যোগ্য ।
১১. সুখ, দুঃখ, প্রাচুর্য ও অভাবে (সর্বাবস্থায়) আমি তাঁর (মহান আল্লাহ) অনেক অনেক প্রশংসা করি, সর্বদা তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি; তাঁর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করি; আমি তাঁর আদেশ শুনি (পালন করি), তিনি যা পছন্দ করেন তা আঞ্জাম দেয়ার দিকে আমি ধাবিত হই; তিনি যা নির্ধারণ করেছেন আমি তাঁর প্রতি আনুগত্য করার ইচ্ছা ও অভিপ্রায় নিয়ে এবং তাঁর আযাবের (শাস্তি) ভয়ে মেনে নেই। কারণ তিনিই আল্লাহ যার কৌশল থেকে নিরাপদ থাকা যায় না এবং যার থেকে অন্যায় ও অত্যাচারের কোনো আশংকা ও ভয় নেই ।
দ্বিতীয় অংশ
১২. আমি তার প্রতি আমার দাসত্বের কথা স্বীকার করছি এবং তাঁর প্রতিপালক হওয়ার বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমার প্রতি যা কিছু ওহি হয়েছে তা আঞ্জাম দেবো (প্রচার করবো)। এমন যেন না হয় যে তা প্রচারে অবহেলা করার কারণে আমার প্রতি কোন আযাব অবতীর্ণ হয়; যা প্রতিহত করার ক্ষমতা কারও নেই; তাই তার ক্ষমতা যত বেশী থাকুক এবং আমার সাথে তার বন্ধুত্ব যত গাঢ়ই হোক না কেন। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। কেননা তিনি আমাকে অবগত (সতর্ক) করেছেন, আমার উপর (আলীর বিষয়ে) যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে তা যদি প্রচার না করি তবে আমি রেসালতের কোন দায়িত্ব পালন করিনি। আর সুমহান আল্লাহ আমাকে মানুষের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আর আল্লাহই হলেন (নিরাপদ রাখার জন্য) যথেষ্ঠ, মহামহিম। সুতরাং তিনি আমার উপর ওহি অবতীর্ণ করেছেন: ‘পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে, ‘হে রাসুল! আপনার প্রভূর পক্ষ থেকে আপনার কাছে [মায়িদাহ: ৬৭] -আলীর ব্যাপারে অর্থাৎ আলী ইবনে আবি তালিবের খিলাফতের ব্যাপারে- যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার করে দিন। আর যদি আপনি তা না করেন তাহলে তাঁর রিসালতই প্রচার করলেন না এবং আল্লাহ্ আপনাকে লোকদের (সমালোচনা, নিন্দা ও বিরোধিতা) থেকে রক্ষা করবেন।’ [মায়িদাহ: ৬৭]
১৩. হে লোকসকল! মহান আল্লাহ্ যা কিছু আমার উপর ওহি করেছেন তা প্রচারের দায়িত্বে আমি অবহেলা করিনি। এখন আমি এ আয়াতের শানে নুযুল তোমাদের উদ্দেশ্যে বর্ণনা করছি, নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক ও রব সালামের পক্ষ থেকে -একমাত্র তিনিই সালাম- জীবরাইল আমার উপর ৩ বার অবতীর্ণ হয়েছে বিশেষ বার্তা নিয়ে; যেন আমি এখানে উঠে দাঁড়াই এবং সাদা-কালো নির্বিশেষে সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করি যে, আলী ইবনে আবি তালিব আমার ভ্রাতা, ওয়াসী, আমার উম্মতের মাঝে আমার খলিফা এবং আমার পরে ইমাম। মুসার নিকট হারুন যে মর্যাদার অধিকারী, সেও (আলী) আমার নিকট একই মর্যাদার অধিকারী, তবে পার্থক্য হল আমার পরে আর কোন নবী আসবে না। সে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের পর তোমাদের ওয়ালী (অভিভাবক) এবং মহান আল্লাহ এতদসংক্রান্ত পবিত্র কুরআনে একটি আয়াত অবতীর্ণ করেছেন; আয়াতটি হল: ‘নিশ্চয়ই তোমাদের ওয়ালী হচ্ছেন মহান আল্লাহ্, তাঁর রাসূল এবং ঐ মুমিনগণ যাঁরা নামায কায়েম (করে) এবং রুকূরত অবস্থায় যাকাত প্রদান করে।’ [মায়িদাহ: ৫৫] নিশ্চয়ই আলী ইবনে আবি তালিব হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে নামায কয়েম করেছে, রুকূরত অবস্থায় যাকাত প্রদান করেছে এবং সার্বক্ষণিক মহান আল্লাহকে চায়।
১৪. আমি জীবরাইলকে অনুরোধ যাতে সে মহান সালামের কাছ থেকে অনুমতি নেয় যেন তিনি বিষয়টি তোমাদের কাছে পৌঁছানোর কাজ থেকে আমাকে অব্যাহতি দেন। -হে লোকসকল!- কেননা আমি ইসলামে মুত্তাকিদের সংখ্যালঘু হওয়া ও মুনাফিকদের সংখ্যাধিক্য, নিন্দুকের ষড়যন্ত্র এবং বিদ্রুপকারীদের কৌশল সম্পর্কে অবগত। যাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ মহান আল্লাহ্ তার পবিত্র গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: ‘তারা মুখে তা বলে, যা তাদের অন্তরে নেই’ [ফাতহ্ : ১১]। ‘এবং তোমরা একে তুচ্ছ গণ্য করেছিলে; যদিও আল্লাহর দৃষ্টিতে এ ছিল গুরুতর বিষয়’ [নূর : ১৫]
১৫. এছাড়াও মুনাফিকরা আমাকে একবার নয় বহুবার কষ্ট দিয়েছে এমনকি তারা আমাকে ‘উযুন’ (যে প্রত্যেকের কথা শোনে ও মেনে নেয়) বলে ডাকে এবং তার (আলী) অধিক সময় ধরে আমার সাথে থাকা, তার প্রতি আমার বিশেষ দৃষ্টি এবং তার কর্তৃক আমাকে গ্রহণ করার কারণে তারা (মুনাফিকরা) এমনটি মনে করতো। এমনকি মহান আল্লাহ্ এ বিষয়ে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন:
তাদের মধ্যে এমন কতিপয় লোক আছে, যারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে, ‘সে প্রত্যেক কথায় কর্ণপাত করে থাকে।’ [তওবাহ: ৬১] -যারা মনে করে তিনি প্রত্যেক কথায় কর্ণপাতকারী, তাদেরকে তুমি বলে দাও- ‘সে কর্ণপাত তো তোমাদের জন্য কল্যাণকর। সে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করে এবং মুমিনদের (কথাকে) বিশ্বাস করে। আর সে তোমাদের মধ্যে বিশ্বাসী লোকদের জন্য করুণাস্বরূপ। যারা আল্লাহর রসূলকে কষ্ট দেয় তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।’ [তওবাহ: ৬১]
আমি চাইলে ‘উযুন’ বলে সম্বোধনকারীদের প্রত্যেকের নাম বলে দিতে পারি, চাইলে তাদের প্রতি ইঙ্গিত করতে পারি, এমনকি ইচ্ছা করলে তাদের সকল চিহ্নবালীসহ তাদের পরিচয় প্রকাশ করে দিতে পারি। কিন্তু আল্লাহর কসম তাদের বিষয়ে আমি উদারতা দেখিয়েছি এবং নিরব থেকেছি।
১৬. এতকিছুর পরও মহান আল্লাহ আমার উপর সন্তুষ্ট হবেন না যতক্ষণ না আমি প্রচার করে দেই যা কিছু (আলীর ইমামত ও বেলায়েতের বিষয়ে) আমার উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে। অতঃপর তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন: ‘হে রাসূল –আলীর (ইমামত ও বেলায়েতের) ব্যাপারে- আপনার প্রভূর তরফ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা আপনি প্রচার করে দিন। আর যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনি তাঁর রিসালতই প্রচার করলেন না এবং মহান আল্লাহ্ আপনাকে লোকদের (নিন্দা, সমালোচনা ও বিরোধিতা) থেকে রক্ষা করবেন।’ [মায়িদাহ : ৬৭]
তৃতীয় অংশ
১৭. হে লোকসকল জেনে রেখো! এ আয়াত তাঁর (আলী) সম্পর্কে। এর গভীরতা বোঝো এবং জেনে রাখো মহান আল্লাহ্ তাকে তোমাদের ওয়ালি (অভিভাবক) এবং ইমাম নিযুক্ত করেছেন এবং তার আনুগত্যকে মুহাজির ও আনসারদের উপর এবং যারা তাদেরকে (মুজাহির ও আনসার) যাবতীয় সৎকর্মে অনুসরণ করেছে তাদের উপর ফরজ করেছেন। (এছাড়া ফরজ করেছেন আলীর আনুগত্য) শহর ও মরুর অধিবাসী, আরব ও আজম, মুক্ত ও দাস, বড় ও ছোট, সাদা ও কালো এবং সকল একত্ববাদীদের উপর। তাঁর কথা ও সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা অবশ্য পালনীয়। সে অভিশপ্ত যে তাঁর বিরোধিতা করে, সে রহমত প্রাপ্ত যে তাঁর আনুগত্য করে এবং তাঁকে সত্যায়িত করে। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্, তাকে এবং তার কথা শ্রবণকারী ও তাঁর আনুগত্যকারীকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
১৮. হে লোকসকল! এই স্থানে শেষবারের মত দাঁড়িয়ে (তোমাদের উদ্দেশ্যে কথা বলছি); অতএব, আমার কথা শোনো ও অনুসরণ করো। আর তোমাদের প্রতিপালকের নির্দেশ মাথা পেতে মেনে নাও। কেননা মহান আল্লাহ্ তিনি তোমাদের অভিভাবক ও তোমাদের উপাস্য, তারপর তোমাদের অভিভাবক হল তাঁর রাসুল ও নবী যে এই মুহূর্তে তোমাদের উদ্দেশ্যে কথা বলছে, আর আমার পরে তোমাদের প্রতিপালক মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে তোমাদের অভিভাবক ও ইমাম হচ্ছে আলী। এরপর আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে তোমাদের সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত ইমামত আলীর ঔরসজাত আমার বংশধরদের মধ্যেই (বিদ্যমান থাকবে)।
১৯. মহান আল্লাহ্, তাঁর রাসূল এবং তারা (ইমামগণ) যা হালাল করেছেন কেবল তা ব্যতীত আর কোন হালাল নেই; আর মহান আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তারা যা হারাম (নিষিদ্ধ) করেছেন কেবল তা ব্যতীত আর কোন হারাম নেই। মহান আল্লাহ্ আমাকে হালাল ও হারাম চিনিয়েছেন। আর আমার প্রতিপালক তাঁর কিতাব থেকে এবং তাঁর কৃত হালাল ও হারাম থেকে যা কিছু শিখিয়েছেন তা আমি আলীকে শিখিয়েছি।
২০. হে লোকসকল! তাকে শ্রেষ্ঠ জেনো। (কারণ) এমন কোন জ্ঞান নেই যা মহান আল্লাহ্ আমার মাঝে দান করেননি। আর যে সকল জ্ঞান আমাকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে আমি তা ইমামুল মুত্তাকীন (পরহেযগার বান্দাদের নেতা) আলীকে শিখিয়েছি। সে হচ্ছে ইমাম-এ মুবিন (পরম সত্য ও স্পষ্টভাষী ইমাম)। যাকে মহান আল্লাহ সূরা ইয়াসিনে এভাবে স্মরণ করেছেন: ‘এবং আমরা সকল জিনিস একজন ইমাম-এ মুবিনের কাছে (সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ) হিসাব ও বিবরণসহ গচ্ছিত ও সংরক্ষিত রেখেছি।’ [ইয়াসিন : ১২]
২১. হে লোকসকল! তাকে ভুলে যেও না, তার থেকে দূরে সরে যেও না, এবং তার বেলায়াত প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করো না; কারণ সে সত্যের দিকে পরিচালিত করে এবং সত্যের ভিত্তিতে আমল করে; সে বাতিলের (মিথ্যা) ধ্বংস সাধন করে এবং বাতিলকে নিষিদ্ধ করে। আর বিদ্রুপকারীদের বিদ্রুপ কখনো তাকে আল্লাহর কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে না।
২২. সে হচ্ছে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়নকারী প্রথম ব্যক্তি। আমার প্রতি ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে কেউ তারচেয়ে অগ্রগামী হতে পারে নি। সে নিজের জীবনকে আল্লাহর রাসূলের প্রতি উৎসর্গ ও কুরবানী করেছে এবং সে ব্যতীত আল্লাহর রাসুলের সাথে মহান আল্লাহর ইবাদতকারী আর কোন পুরুষ ছিল না।
২৩. আলী হল লোকদের মধ্যে প্রথম নামায আদায়কারী এবং আমার সাথে মহান আল্লাহর প্রথম ইবাদতকারী। আমি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে নির্দেশ দিয়েছি যাতে সে (হিজরতের রাতে) আমার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে। আর সেও এ নির্দেশ মেনে নিজের জীবনকে আমার জন্য উৎসর্গ করেছে।
২৪. হে লোকসকল! তাকে শ্রেষ্ঠ বলে বিশ্বাস করো, কেননা নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। আর তার নেতৃত্বকে মেনে নাও কারণ মহান আল্লাহ তাকে (নেতৃত্বের আসনে) অধিষ্ঠিত ও (ইমাম হিসেবে) নিযুক্ত করেছেন।
২৫. হে লোকসকল! সে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইমাম। আর যে কেউ তার বেলায়াত অস্বীকার করবে তিনি তার তওবা কক্ষনো কবুল করবেন না এবং তাকে কক্ষনো ক্ষমাও করবেন না। আর যে কেউ তার (আলী) ইমামতের বিরোধিতা করবে তার সাথে মহান আল্লাহর সুনিশ্চিত আচরণ এমনই এবং নিশ্চয়ই তাকে (অস্বীকারকারী) যন্ত্রণাদায়ক আযাবে নিমজ্জিত করবেন চিরস্থায়ীভাবে। অতএব, তার সাথে বিরোধিতার বিষয়ে ভয় পাও, তা না হলে ঐ আগুনে পতিত হবে ‘যার ইন্ধন হচ্ছে মানুষ ও পাথর’ [তাহরিম: ৬] ‘যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফেরদের জন্য।’ [আলে ইমরান: ১৩১]
২৬. হে লোকসকল! আল্লাহর শপথ, আমার আগমন সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলগণ সুসংবাদ প্রদান করেছেন। আল্লাহর কসম, আমি সর্বশেষ নবী ও রাসুল এবং আকাশসমূহ ও পৃথিবীর বাসিন্দা সমগ্র সৃষ্টিজগতের উপর হুজ্জাত (প্রামাণ্য দলীল); অতএব, যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে সন্দেহ করবে সে কুফর করবে জাহিলিয়াতের কুফর! আর যারা আমার এ কথায় সন্দেহ করবে নিশ্চয় সে সন্দেহ করেছে আমার উপর যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলোয়। যে ব্যক্তি যে কোন একজন ইমামের ব্যাপরে সন্দেহ পোষণ করবে সে আসলে সকল ইমামের ব্যাপারেই সন্দেহ পোষন করল; আর আমাদের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণকারী জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে।
২৭. হে লোকসকল! এ শ্রেষ্ঠত্ব দানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন এবং দয়ার্দ্রতা দেখিয়েছেন, তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। জেনে রাখো, চিরস্থায়ীভাবে এবং সর্বাবস্থায় আমার সমস্ত প্রশংসা তাঁর জন্যই নির্ধারিত।
২৮. হে লোকসকল! আলীকে তোমরা শ্রেষ্ঠ মনে করো, কেননা সে আমার পরে নারী ও পুরুষদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, ততদিন পর্যন্ত যতদিন সৃষ্টিজগত টিকে আছে এবং মহান আল্লাহ তাদের জন্য রুজির ব্যবস্থা করছেন। যে কেউ আমার এ কথা প্রত্যাখ্যান করবে এবং এর সাথে একমত না হবে সে অভিশপ্ত (ও মহান আল্লাহর রহমত থেকে দূরে) এবং মহান আল্লাহর ক্রোধভাজন। জেনে রাখো! জিবরাইল (আমিন) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাকে অবগত করেছেন যে, তিনি বলেছেন: ‘যে আলীর সাথে শত্রুতায় জড়াবে এবং তার বেলায়াত মেনে নেবে না, তার উপর আমার লানত ও ক্রোধ (বর্ষিত হবে)’। ‘আর প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক যে, আগামী-কালের (কিয়ামতের) জন্য সে কি অগ্রিম পাঠিয়েছে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর।।’ [হাশর : ১৮] ‘তা –আলীর সাথে বিরোধিতা- করলে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পা আবার পিছলে যাবে।’ [নাহল : ৯৪] ‘তোমরা যা কর আল্লাহ্ সে সম্পর্কে পুরোপুরি খবর রাখেন।’ [হাশর : ১৮]
২৯. হে লোকসকল! সে হল ‘জানবুল্লাহ’ যার কথা মহান আল্লাহ্ তাঁর পবিত্র গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং তার (আলী) বিরোধীদের সম্পর্কে বলেছেন: ‘হায় আফসোস! জানবুল্লাহ’র প্রতি আমার কর্তব্যে আমি তো শৈথিল্য করেছি’। [যুমার : ৫৬]
৩০. হে লোকসকল! পবিত্র কুরআন নিয়ে তোমরা গভীরভাবে চিন্তা করো এবং এর আয়াতসমূহের গভীরতা সম্পর্কে অবগতি লাভ করো, এর মুহকাম আয়াতসমূহের উপর দৃষ্টি রাখো এবং এর মুতাশাবাহ আয়াতগুলোর অনুসরণ করো না। মহান আল্লাহর কসম! এই ব্যক্তি (আলী) ব্যতীত আর কেউ পবিত্র কুরআনের বাতিন (অপ্রকাশিত অন্তর্নিহিত অর্থ) বর্ণনা এবং তা ব্যাখ্যা করতে পারে না; যার হাত আমি ধরে রেখেছি এবং যার বাহু ধরে যাকে আমি উঁচু করেছি এবং যার সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে অবগত করছি: আমি যার মাওলা এই আলী তার মাওলা এবং সে হল আলী ইবনে আবি তালিব আমার ভাই, ওয়াসী; মহান আল্লাহ নিজেই তাঁর মুওয়ালাত করার বিধান (তাকে মহব্বত ও ভালবাসার বিধান) আমার উপর অবতীর্ণ করেছেন।
৩১. হে লোকসকল! নিশ্চয়ই আলী এবং তার (ঔরসজাত) আমার পবিত্র সন্তানগণ হল ‘সিকলুল আসগার’ এবং কুরআন হল ‘সিকলুল আকবার’। অতএব, এদের উভয় পরস্পর সম্পর্কে সংবাদকারী এবং এরা পরস্পরের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। এরা হাওজে কাউসরে আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।। জেনে রেখো! এরা সৃষ্টিকূলের মাঝে মহান আল্লাহর বিশ্বস্ত আমানতদার এবং পৃথিবীতে মহান আল্লাহর (মনোনীত) শাসক।
৩২. মনে রেখো! আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি, (অবতীর্ণ হওয়া বার্তা) প্রচার করেছি, (তা) তোমাদের কর্ণ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছি এবং (সত্যকে) স্পষ্ট করেছি। এটা ছিল মহান আল্লাহর কথা আর আমি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে বলেছি।
৩৩. জেনে রেখো! আমার এই ভাই (আলী) ব্যতীত কোন আমিরুল মু’মিনীন (মু’মিনদের নেতা) নেই; একমাত্র আলী ব্যতীত আমার পরে মুমিনদের নেতৃত্ব আর কারও জন্য জায়েজ (সিদ্ধ ও বৈধ) হবে না।
চতুর্থ অংশ
৩৪. অতঃপর তিনি বললেন: হে লোকসকল! তোমাদের নিজেদের চেয়ে তোমাদের কাছে কে সবচেয়ে নিকটবর্তী? তারা বললো: আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল। তখন তিনি বললেন: আমি যার মাওলা (অভিভাবক) এই আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ্ যে তাকে ভালবাসে তাকে আপনি ভালবাসুন, আর যে তার সাথে শত্রুতা পোষণ করে তার সাথে আপনি শত্রুতা পোষণ করুন, যে তাকে সাহায্য করবে আপনি তাকে সাহায্য করুন, আর যে তাকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবে তাকে আপনি সাহায্য করা থেকে বিরত থাকুন।
৩৫. হে লোকসকল! এ হচ্ছে আলী; আমার ভাই, ওয়াসী, আমার জ্ঞানের রক্ষক, আর আমার উম্মতের মধ্যে তাদের উপর আমার খলিফা যারা আমার প্রতি এবং মহান আল্লাহর কিতাবের তাফসিরের উপর ঈমান এনেছে। সে জনগণকে আল্লাহর দিকে আহবান জানায়। আর যা কিছুতে তিনি (আল্লাহ) সন্তুষ্ট হন তা আঞ্জাম দানকারী এবং তাঁর শত্রুদের সাথে যুদ্ধকারী। তাঁর আনুগত্য ও সহযোগিতাকারী এবং তাঁর বিরুদ্ধাচারণে নিষেধকারী।
৩৬. নিশ্চয়ই সে আল্লাহর রাসুলের খলিফা, মুমিনদের আমির ও আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়েতকারী ইমাম। সে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাকিসিন (প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী), কাসিতিন (অবাধ্য) এবং মারিকীনদের (খারিজীদের) সাথে যুদ্ধকারী।
৩৭. মহান আল্লাহ বলেন: ‘আমার কথা কক্ষনো বদলে না’ [ক্বাফ : ২৯] হে আমার প্রতিপালক! আপনার নির্দেশেই বলছি: হে আল্লাহ্ যে তাকে ভালবাসে তাকে আপনি ভালবাসুন। আর যে তার সাথে শত্রুতা পোষণ করে তার সাথে আপনি শত্রুতা পোষণ করুন, যে তাকে সাহায্য করবে আপনি তাকে সাহায্য করুন, আর যে তাকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবে তাকে আপনি সাহায্য করা থেকে বিরত থাকুন। যে তাকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করবে আপনি তাকে লানত দিন এবং যে তার ন্যায্য অধিকার (হক) অস্বীকার করবে তার উপর আপনি ক্রোধান্বিত হন।
৩৮. হে আল্লাহ্, নিশ্চয়ই আপনি আপনার ওয়ালী আলীর ব্যাপারে এবং আজকের এ দিনে তাকে (অভিভাবক) নিযুক্ত করণ সংক্রান্ত একটি আয়াত অবতীর্ণ করেছেন: ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা প্রদান করেছি, তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করে দিয়েছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন (ধর্ম) হিসেবে মনোনীত (ও পছন্দ) করেছি।’ [মায়িদাহ: ৩] আপনি বলেছেন: ‘নিশ্চয় ইসলাম আল্লাহর নিকট (একমাত্র মনোনীত) ধর্ম।’ [আলে ইমরান: ১৯]। আপনি আরও বলেছেন: ‘যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম অন্বেষণ করবে, তার পক্ষ হতে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না। আর সে হবে পরলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত।’ [আলে ইমরান : ৮৫]
৩৯. হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী থেকো, নিশ্চয়ই আমি (তোমার বার্তাকে জনগণের নিকট) পৌঁছে দিয়েছি।
পঞ্চম অংশ
৪০. হে লোকসকল! মহান আল্লাহ্ তোমাদের দ্বীনকে তার (আলী) ইমামতের মাধ্যমে পূর্ণতা দিয়েছেন। অতএব, কেয়ামত পর্যন্ত যে তার (আলী) এবং তার স্থলাভিষিক্ত তার ঔরসজাত আমার সন্তানদেরকে অনুসরণ করবে না, ‘তাদেরসকল আমল দুনিয়ায় এবং আখেরাতে ব্যর্থ হয়ে যাবে।’ [বাকারাহ : ২১৭] ‘এবং ওরা জাহান্নামে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে’। [তওবাহ: ১৭] ‘না তাদের শাস্তি শিথিল করা হবে আর না তাদেরকে অবকাশ দেয়া হবে না’। [বাকারাহ : ১৬২]
৪১. হে লোকসকল! এই আলী তোমাদের মধ্য থেকে আমার সর্বাধিক সাহায্যকারী, তোমাদের মধ্য থেকে আমার নিকট সবচেয়ে যোগ্য, তোমাদের মধ্য থেকে আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী, তোমাদের মধ্য থেকে আমার নিকট সবচেয়ে মর্যাদাবান। মহান আল্লাহ এবং আমি উভয়ই তার প্রতি সন্তুষ্ট। পবিত্র কুরআনে যাবতীয় সন্তুষ্টির আয়াত তার শানেই অবতীর্ণ হয়েছে। আর মহান আল্লাহ্ আলীকে দিয়ে শুরু করা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সম্বোধন করেন নি (সর্বপ্রথম আলীকে সম্বোধন করেছেন)। পবিত্র কুরআনে এমন কোন প্রশংসার আয়াত নেই যার মাঝে সে নেই। সূরা ‘হাল আতা আলাল ইনসান’ (সূরা ইনসান)-এ আল্লাহ যার বেহেশতের সাক্ষ্য দিয়েছেন সে (আলী) ব্যতীত আর কেউ নয়। আর এটা আলী ব্যতীত অন্য কারও শানে তিনি অবতীর্ণ করেননি এবং এর মাধ্যমে সে ব্যতীত অন্য কারো প্রশংসা করা হয়নি।
৪২. হে লোকসকল! সে (আলী) আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী এবং আল্লাহর রাসূলের প্রতিরক্ষাকারী। সে তাকওয়াবান, পবিত্র, পথপ্রদর্শক এবং (সত্য) পথপ্রাপ্ত। তোমাদের নবী সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, তোমাদের মাঝে তার ওয়াসীও (স্থলাভিষিক্ত) সর্বশেষ্ঠ ওয়াসী এবং তার সন্তানরা সর্বোত্তম ওয়াসী। হে লোকসকল! প্রত্যেক নবীর বংশধারা তার ঔরসজাত কিন্তু আমার বংশধর আমিরুল মুমিনীন আলীর ঔরসজাত।
৪৩. হে লোকসকল! নিশ্চয়ই শয়তান হিংসাবশত আদমকে (প্রতারণার মাধ্যমে) বেহেশত থেকে বিতাড়িত করেছে। তোমরা যেন আলীকে হিংসা করো না, (হিংসা করলে) তোমাদের আমল ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তোমাদের পদস্খলন হবে। একটি মাত্র ভুলের (নির্দেশ অমান্য করার) কারণে আদমকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল, অথচ তিনি ছিলেন মহান আল্লাহর মনোনীত। তাহলে (ভেবে দেখো) তোমাদের অবস্থা কেমন হবে, তোমরা আছো আর তোমাদের মধ্য থেকে আল্লাহর শত্রুও রয়েছে (সুতরাং সাবধান)।
৪৪. জেনে রেখো! দুর্ভাগা (কমবখ্ত) ব্যতীত কেউ আলীর প্রতি শত্রুতা করে না এবং মুত্তাকি ব্যতীত আলীকে কেউ অভিভাবক হিসেবে ভালবাসে না। আর একনিষ্ঠ ও মুখলেস ঈমানদার ব্যতীত তার প্রতি কেউ ঈমান আনবে না। আল্লাহর কসম! সূরা আসর আলীর শানেই অবতীর্ণ হয়েছে: ‘মহাকালের শপথ। নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মাঝে নিপতিত’; [আসর : ১-২] –আলী ব্যতীত; যে ঈমান এনেছে এবং সত্য ও ধৈর্য্যের প্রতি সন্তুষ্ট থেকেছে’।
৪৫. হে লোকসকল! মহান আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি যে, আমি আমার রেসালাত (যা প্রচারের জন্য নির্দেশ প্রাপ্ত হয়েছিলাম তা) তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। ‘আর রাসূলের দায়িত্ব তো কেবল স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়া।’ [নূর : ৫৪]
৪৬. হে লোকসকল! ‘আল্লাহকে ভয় করো যেমনভাবে তাঁকে ভয় করা উচিত এবং তোমরা মুসলিম (আত্মসমার্পনকারী) না হয়ে কক্ষনো মৃত্যুবরণ করো না’। [আলে ইমরান: ১০২]
ষষ্ঠ অংশ
৪৭. হে লোকসকল! ‘তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করো আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি আর যে নূর (কুরআন)...’ [তাগাবুন : ৮] তার সাথে নাজিল করা হয়েছে তার প্রতি‘আমরা মুখমণ্ডলগুলোকে বিকৃত করে তারপর সেগুলোকে পিছনের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার আগে অথবা আস্হাবুস্ সাব্তকে যেরূপ লা’নত করেছিলাম সেরূপ তাদেরকে লা’নত করার আগে।’ [নিসা : ৪৭] আল্লাহর কসম! এ আয়াতে মহান আল্লাহ আমার সাহাবীদের ঐ দলকে বুঝিয়েছেন যাদের আমি চিনি তাদের নাম ও বংশ পরিচয়সহ। কিন্তু আমি তাদের কর্মকাণ্ডকে গোপন রাখার বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছি। অতএব, প্রত্যেক মানুষেরই উচিত নিজের অন্তরে আলীর প্রতি ভালবাসা বা তার প্রতি ঘৃণার ভিত্তিতে নিজেদের কার্যাদি সম্পাদন করা।
[আসহাবুস সাব্ত: শনিবার দিবসে বনী ইসরাইলের মৎস্য শিকার কারীগণ যারা অভিশপ্ত হয়েছিল নিষিদ্ধ মৎস্য শিকারের জন্য।]
৪৮. হে লোকসকল! মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর কেবল আমার মাঝেই স্থাপন করা হয়েছে। অতঃপর তা আলী ইবনে আবি তালিবের মাঝে। অতঃপর তা আল-ক্বায়েম আল-মাহদি পর্যন্ত তার বংশধরদের মাঝে (স্থাপন করা হয়েছে) যে আল্লাহর অধিকার এবং আমাদের সমস্ত অধিকারকে আদায় করে নেবে। কেননা মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে বিশ্বের সকল দোষী, শত্রু, বিরোধী, বিশ্বাস ঘাতক, গুনাহগার, অত্যাচারী ও অধিকার হরণকারীর উপর হুজ্জাত (প্রামাণ্য দলিল) বানিয়েছেন।
৪৯. হে লোকসকল! তোমাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছি, আমি আল্লাহর রাসূল ‘তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়ে গেছে। সুতরাং সে আমি মারা যাই অথবা নিহত হই, তাহলে কি তোমরা তোমাদের পেছনে (জাহিলিয়াতের যুগে) ফিরে যাবে? বস্তুতঃ যে পেছনে ফিরে যায়, সে কখনও আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর অচিরেই আল্লাহ কৃতজ্ঞ -ও ধৈর্য্যশীল- ব্যক্তিবর্গকে পুরস্কৃত করবেন।’ [আলে ইমরান : ১৪৪]
৫০. জেনে রেখো, আলী ধৈর্য্যশীলতা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের করার গুণে গুণান্বিত এবং (একইভাবে) তার পর তার ঔরসজাত আমার সন্তানগণ। (অর্থাৎ আলী ও তার ঔরসজাত আমার সন্তানগণ এ দুই গুণে গুণান্বিত)
৫১. হে লোকসকল! তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করেছো বলে মনে করো না। (আর এটাও মনে করো না যে,) তোমরা (ইসলাম গ্রহণ করে) আল্লাহর প্রতি অনুগ্রহ করেছো। যদি এমনটি করো তাহলে তিনি তোমাদের আমলকে বৃথা ও ধ্বংস করে দেবেন এবং তোমাদের উপর অসন্তুষ্ট হবেন। আর ‘তোমাদেরকে অগ্নি শিখা ও ধূম্রপঞ্জের (অথবা গলিত তামা) আজাবে’ [রাহমান: ৩৫] নিপতিত করবেন’। ‘নিশ্চয় তোমার –তোমাদের- প্রতিপালক সময়ের প্রতীক্ষায় থেকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন’। [ফাজর : ১৪]
৫২. হে লোকসকল! আমার পরে অচিরেই এমন নেতারা আসবে ‘তারা লোকদেরকে জাহান্নামের দিকে আহবান করবে এবং কিয়ামতের দিন তারা কোন সাহায্য পাবে না’। [কাসাস : ৪১]
৫৩. হে লোকসকল! নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ এবং আমি উভয়ই তাদের থেকে মুক্ত ও পৃথক। (অর্থাৎ তাদের সাথে মহান আল্লাহ্ ও আমার কোনো সম্পর্ক নেই)
৫৪. হে লোকসকল! নিশ্চয়ই তারা, তাদের সাহায্যকারীরা, তাদের অনুসারীরা এবং তাদের সমপন্থীরা ‘দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে’ [নিসা : ১৪৫] ‘আর দাম্ভিকদের আবাসস্থল কতই না মন্দ!’ [নাহল : ২৯]
৫৫. জেনে রেখো! তারা আসহাবে সাহিফাহ। অতএব, তোমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজের সাহিফাহ’র (আমলনামার) দিকে দৃষ্টি রাখা!!
[আসহাবে সাহিফা: কতিপয় ব্যক্তি যারা রাসূলুল্লাহর (স.) জীবদ্দশায়ই হযরত আলী (আ.) যাতে খিলাফতে অধিষ্ঠিত হতে না পারেন সেজন্য মহানবী (স.) কর্তৃক গাদীর-এ খুমে হরত আলীর বেলায়াতের ঘোষণা দানের আগেই পরস্পর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল]
৫৬. হে লোকসকল! আমি খেলাফতকে ইমামত ও উত্তরাধিকার হিসেবে কেয়ামত পর্যন্ত আমার বংশধরদের মাঝে হিসেবে রেখে যাচ্ছি। আর আমাকে যে বিষয়টি প্রচারের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, আমি তা প্রচার করে দিয়েছি। যাতে সকল উপস্থিত ও অনুপস্থিত, যারা দেখেছে ও যারা দেখেনি এবং যাদের জন্ম হয়েছে বা জন্ম হয়নি তাদের সকলের জন্য হুজ্জাত (প্রামাণ্য দলিল) হিসেবে বিবেচিত হয়। অতএব, উপস্থিত ব্যক্তি যে অনুপস্থিত আছে তার কাছে এবং কিয়ামত দিবস পর্যন্ত পিতা পুত্রের কাছে (গাদীরে খুমের এ মহাঘটনা) প্রচার (ও বর্ণনা) করবে।
৫৭. আমার পর অতশীঘ্রই তারা ইমামতকে (খেলাফত) জবর দখল করে তা রাজতন্ত্রে পরিণত করবে। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ জবর দখলকারী ও যার বলপূর্বক ছিনিয়ে নেয় তাদেরকে উপর লানত করেন। আর এটা তখন ঘটবে যখন ‘হে মানুষ ও জ্বিন! আমি -তিনি- শীঘ্রই তোমাদের (হিসাব-নিকাশের) জন্য তোমাদের প্রতি মনোনিবেশ করবেন।’ [আর-রহমান : ৩১] আর যে অতিক্রম করতে চাইবে ‘তোমাদের উভয়ের প্রতি প্রেরণ করা হবে অগ্নিশিখা ও কালো ধোঁয়া (অথবা গলিত তামা) তখন তোমরা প্রতিরোধ করতে পারবে না।’ [রাহমান: ৩৫]
৫৮. হে লোকসকল! ‘অপবিত্র (মুনাফিক)-কে পবিত্র (মুমিন) হতে পৃথক না করা পর্যন্ত মহান আল্লাহ -তোমাদেরকে- মুমিনদেরকে তোমাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেবেন না। অদৃশ্য সম্পর্কে তোমাদের অবহিত করা আল্লাহর (কর্তব্য) নয়।’ [আলে ইমরান : ১৭৯]
৫৯. হে লোকসকল! এমন কোন জনপদ নেই যে, আল্লাহ্ (তার বাসিন্দাদেরকে তাঁর নিদর্শনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে) কেয়ামতের আগে ধ্বংস করবেন না এবং ইমাম মাহদিকে সেই ভূখণ্ডের অধিপতি ও শাসনকর্তা করবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণে সত্যবাদী।
৬০. হে লোকসকল! তোমাদের পূর্ববর্তীদের অধিকাংশ বিভ্রান্ত হয়েছে এবং মহান আল্লাহই (তোমাদের) পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছেন, আর তিনিই পরবর্তীতে আগমনকারীদের ধ্বংসকারী। মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘আমরা কি পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করিনি? অতঃপর আমি পরবর্তীদেরকে তাদের অনুগামী করব। অপরাধীদের প্রতি আমি এরূপই করে থাকি। সে দিন দুর্ভোগ সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্য’। [মুরসালাত : ১৬-১৯]
৬১. হে লোকসকল! নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং নিষেধ করেছেন। আর নিশ্চয়ই আমি তাঁর নির্দেশে আলীকে নির্দেশ দিয়েছি এবং নিষেধ করেছি। অতএব, আদেশ ও নিষেধের জ্ঞান তার (আলী) কাছে। নিরাপদ থাকতে তার কথা শোনো এবং হেদায়েত পেতে তার নির্দেশ পালন করো আর সে যা কিছু থেকে বিরত থাকতে বলে তা থেকে যদি বিরত থাকো তাহলে সুপথ প্রাপ্ত হবে। তার কাংখিত লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হও, আর তোমাদের পথসমূহ তার পথ থেকে ভিন্ন হবে না।
৭ম অংশ
৬২. হে লোকসকল! আমি আল্লাহর সরল সঠিক পথ (সিরাত-এ মুস্তাকিম); যা অনুসরণ করতে ও মেনে চলতে মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। অতঃপর আমার পরে আলী (হচ্ছে সিরাত-এ মুস্তাকিম), তার পর তার ঔরসজাত আমার বংশধর (থেকে) হিদায়াতের ইমামগণ; যারা সত্যের দিকে পরিচালিত করে আর ‘সত্য বিধান অনুযায়ী ইনসাফ ও ন্যায়বিচার করে’। [আরাফ : ১৫৯] অতঃপর তিনি তেলাওয়াত করলেন: ‘অনন্ত করুণাময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে (আরম্ভ করছি)। সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য। যিনি অনন্ত করুণাময়, পরম দয়ালু। (যিনি) বিচার দিনের মালিক। আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই। আমাদেরকে সরল (সোজা) পথ দেখাও; তাদের পথ- যাদেরকে তুমি নিয়ামত দান করেছ; তাদের পথ যারা ক্রোধভাজন নয় এবং যারা পথভ্রষ্টও নয়।’ [সূরা ফাতিহা] তিনি বলেন: এ সূরা আমার শানে অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহর শপথ, এ সূরা আমার সন্তানদের শানে অবতীর্ণ হয়েছে। এ সূরাটি তাদের সবাইকে শামিল (অন্তর্ভুক্ত) করেছে এবং তাঁদেরকেই (সকলের থেকে) পৃথক ও স্বতন্ত্র করেছে, এরাই আল্লাহর বন্ধু যাদের ‘না কোন আশংকা আছে আর না তারা চিন্তিত হবে।’ [ইউনুস : ৬২] ‘নিশ্চয় আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।’ (মায়িদাহ : ৫৬)
৬৩. সাবধান! তাদের শত্রুরা হল নির্বোধ এবং প্রবলুব্ধকারী যারা শয়তানদের সহযোগী ভাই; ‘প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে তারা একে অপরের কাছে চিত্তাকর্ষক কথাবার্তা বলে’। [আনআম : ১১২]
৬৪. জেনে রাখো! নিশ্চয়ই তাদের বন্ধুদের কথাই মহান আল্লাহ্ স্বীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহ্ বলেন: ‘আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায় তুমি পাবে না যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারীদেরকে ভালবাসে- হোক না এই বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা অথবা পুত্র অথবা তাদের ভাই অথবা তাদের জ্ঞাতি গোষ্ঠী। আল্লাহ এদের অন্তরে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন, আর নিজের পক্ষ থেকে রূহ দিয়ে তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন। তাদেরকে তিনি দাখিল করবেন জান্নাতে যার তলদেশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী-নালা, তাতে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এরাই আল্লাহর দল; জেনে রেখ, আল্লাহর দলই সফলকাম।’ [মুজাদালাহ : ২২]
৬৫. জেনে রেখো! তাদের (ইমামগণের) বন্ধুদের বৈশিষ্ট্য মহান আল্লাহ এভাবে তুলে ধরে বলেছেন: ‘যারা বিশ্বাস করেছে এবং তাদের বিশ্বাসকে যুলুম (শিরক) দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা কেবল তাদেরই জন্য এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত’। [আনআম : ৮২]
৬৬. জেনে রেখো! নিশ্চয়ই তাদের বন্ধু ও সহযোগীরা হল ঈমান আনয়নকারীগণ ‘এবং যারা কোনরূপ সন্দেহ পোষণ করে না’। [হুজুরাত : ১৫]
৬৭. জেনে রেখো! নিশ্চয়ই তাদের বন্ধুরা যারা বেহেশতে প্রবেশ করবে ‘শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে।’ [হিজর : ৪৬] ফেরেশতারা সালামের মাধ্যমে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাবে এবং বলবে: ‘তোমাদের উপর শান্তি (বর্ষিত হোক), চমৎকার কাজ করেছ তোমরা, কাজেই স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য জান্নাতে প্রবেশ কর।’ [যুমার : ৭৩]
৬৮. জেনে রেখো! নিশ্চয়ই তাদের (ইমামদের) বন্ধুদের জন্য রয়েছে বেহেশত ‘তাতে তারা বিনা হিসাবে (অফুরন্ত) রিযক প্রাপ্ত হবে।’। [গাফির : ৪০]
৬৯. সাবধান! তাদের শত্রুরা ‘শীঘ্রই জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে।’ [নিসা : ১০]
৭০. জেনে রাখো! তাদের শত্রুরাই জাহান্নামের আর্তনাদ শুনবে, আর তা (জাহান্নাম) বিস্ফোরিত হয়ে ফেটে বের হয়ে আসবে এবং তারা এর চীৎকার প্রত্যক্ষ্য করবে।
৭১. জেনে রেখো! তাদের শত্রুরা হচ্ছে তারা যাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘যখনই কোন দল তাতে প্রবেশ করবে, তখনই অপর দলকে তারা অভিসম্পাত করবে। পরিশেষে যখন সকলে ওতে একত্র হবে, তখন তাদের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! ওরাই আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল, সুতরাং তুমি ওদেরকে দোযখের দ্বিগুণ শাস্তি দাও।’ আল্লাহ বলবেন, ‘প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ রয়েছে; কিন্তু তোমরা জান না।’ [আরাফ : ৩৮]
৭২. জেনে রেখো! তাদের শত্রুরা হচ্ছে তারা যাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘যখনই তাতে কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, তখনই তাদেরকে তার রক্ষীরা জিজ্ঞাসা করবে, ‘তোমাদের নিকট কি কোন সতর্ককারী আসেনি?’[৮] তারা বলবে, ‘অবশ্যই আমাদের নিকট সতর্ককারী এসেছিল, কিন্তু আমরা তাদেরকে মিথ্যাবাদী গণ্য করেছিলাম এবং বলেছিলাম, আল্লাহ কিছুই অবতীর্ণ করেননি, তোমরা তো মহা বিভ্রান্তিতে রয়েছ।’[৯] তারা আরো বলবে, ‘আমরা যদি শুনতাম অথবা বুঝতাম তাহলে আমরা জ্বলন্ত আগুনের বাসিন্দাদের মধ্যে শামিল হতাম না। [১০] তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে। সুতরাং জাহান্নামীরা (আল্লাহর রহমত হতে) দূর হোক!’ [ মুলক : ৮-১১]
৭৩. জেনে রেখো! নিশ্চয়ই তাদের বন্ধুরা হচ্ছে তারাই ‘যারা না দেখেও তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।’ [মুলক : ১২]
৭৪. হে লোকসকল! (দেখো) জাহান্নামের আগুন এবং মহাপুরস্কারের মাঝে কত বেশী দূরত্ব।
৭৫. হে লোকসকল! আমাদের শত্রুরা হল তারা যাদেরকে মহান আল্লাহ তিরস্কার করেছেন এবং যাদেরকে লানত দিয়েছেন। আর আমাদের বন্ধুরা হল তারা যাদেরকে মহান আল্লাহ্ প্রশংসা করেছেন এবং যাদেরকে তিনি ভালবাসেন।
৭৬. হে লোকসকল! তোমরা জেনে রেখো যে, আমি সতর্ককারী এবং আলী সুসংবাদ প্রদানকারী।
৭৭. হে লোকসকল! জেনে রেখো! আমি একজন ভয় প্রদর্শনকারী এবং আলী একজন পথপ্রদর্শক (হাদী)।
৭৮. হে লোকসকল! জেনে রেখো! আমি হলাম নবী এবং আলী হচ্ছে আমার ওয়াসী।
৭৯. হে লোকসকল! তোমরা জেনে রেখো যে, আমি একজন রাসূল, আলী হচ্ছে আমার পরে ইমাম ও ওয়াসী এবং তার পর ইমামগণ হবে তার বংশধরগণ। জেনে রাখো! আমি তাদের পিতা (অথচ) তারা আলীর ঔরসজাত।
৮ম অংশ
৮০. জেনে রেখো! নিশ্চয়ই আমাদের সর্বশেষ ইমাম হবে আল-ক্বায়েম আল-মাহদি। জেনে রেখো! সে হবে সকল ধর্মের উপর বিজয়ী, জেনে রেখো যে, জালিমদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী। জেনে রেখো যে, সে হবে দূর্গগুলোর বিজয়ী এবং সেগুলোর ধ্বংসকারী। জেনে রেখো যে, সে হবে সকল মুশরিক গোত্রগুলোর উপর বিজয় লাভকারী এবং গোত্রগুলোর পথ প্রদর্শক।
৮১. জেনে রেখো! সে-ই আল্লাহর সকল আওলিয়াদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারী এবং জেনে রেখো যে, নিশ্চয়ই সে-ই আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী।
৮২. জেনে রেখো! নিশ্চয়ই সে (ঐশী জ্ঞান) গভীর সমুদ্র থেকেও আনবে। সে প্রত্যেক মর্যাদাবানকে তার মর্যাদা এবং প্রত্যেক মূর্খকে তার মূর্খতার চিহ্ন দ্বার চিহ্নিত করবে। জেনে রেখো! সে-ই মহান আল্লাহর পছন্দের এবং তাঁর নির্বাচিত। সে সকল জ্ঞানের উত্তরাধিকারী এবং সকল ধীশক্তির অধিকারী।’
৮৩. জেনে রেখো! সে মহান প্রতিপালক সম্পর্কে সংবাদ দাতা এবং তাঁর নিদর্শনাবলীকে সুসজ্জিত ও সু্উচ্চকারী। জেনে রেখো! সে-ই সুপথপ্রাপ্ত ও সত্যান্বেষী। জেনে রেখো! তার কাছে (মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে) বিশ্ববাসীর বিষয়াদির দায়িত্বভার ন্যাস্ত করা হয়েছে।
৮৪. জেনে রেখো! পূর্ববর্তীরা বহু শতাব্দি আগে তার আগমনের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন।
৮৫. জেনে রেখো! সেই হচ্ছে হুজ্জাত হিসেবে অবশিষ্ট ও বিদ্যমান (বাকী) এবং তার পরে আর কোন হুজ্জাত নেই, সত্য কেবল তারই সাথে আর নূর কেবল তারই কাছে।
৮৬. জেনে রেখো! তার উপর কেউ বিজয়ী হবে না এবং তার শত্রু কোন সাহায্য পাবে না। জেনে রেখো, সে ধরণীর বুকে মহান আল্লাহর ওয়ালী, তাঁর সৃষ্টিকূলে তাঁর (কর্তৃক নিযুক্ত) হাকাম (ফয়সালাকারী বিচারক) এবং মহান আল্লাহর গুপ্ত ও প্রকাশিত সকল বিষয়ে আমীন (বিশ্বস্ত সংরক্ষক ও আমানতদার)।
৯ম অংশ
৮৭. হে লোকসকল! আমি মহান আল্লাহর বার্তা তোমাদের নিকট স্পষ্ট বর্ণনা করেছি এবং তোমাদেরকে বুঝিয়েছি। এ হচ্ছে আলী; সে আমার পরে তোমাদেরকে অবগত করবে ও বোঝাবে।
৮৮. জেনে রেখো! আমার খোতবার শেষে তোমাদেরকে আহবান জানাচ্ছি তার (আলী) হাতে বাইয়াত এবং তার ইমামতের স্বীকারোক্তির বিষয়ে প্রথমে আমার হাতে হাত রাখবে (বাইয়াত করবে) তারপর তার হাতে হাত রাখবে।
৮৯. জেনে রেখো! আমি আল্লাহর সাথে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) করেছি, আর আলী আমার সাথে বাইয়াত করেছে, আর (এখন) আমি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার (আলী) ইমামতের বিষয়ে তোমাদের থেকে বাইয়াত গ্রহণ করছি। ‘নিশ্চয় যারা তোমার বাইআত গ্রহণ করে, তারা তো আল্লাহরই বায়আত গ্রহণ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর। সুতরাং যে তা ভঙ্গ করে, তা ভঙ্গ করার পরিণাম তাকেই ভোগ করতে হবে এবং যে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার পূর্ণ করে, তিনি তাকে মহাপুরস্কার দেবেন।’ [ফাতহ : ১০]
১০ম অংশ
৯০. হে লোকসকল! নিশ্চয়ই হজ্ব এবং উমরাহ আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম, ‘সুতরাং যে কা’বাগৃহের হজ্ব কিংবা উমরাহ সম্পন্ন করে, তার জন্য এই (পাহাড়) দু’টি প্রদক্ষিণ (সাঈ) করলে কোন পাপ নেই। আর কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন পুণ্য কাজ করলে, আল্লাহ গুণগ্রাহী, সর্বজ্ঞাতা।’ [বাকারাহ : ১৫৮]
৯১. হে লোকসকল! (মহান আল্লাহর) গৃহের হজ্ব আঞ্জাম দাও, যে পরিবারই তাতে প্রবেশ করেছে সে (পরিবার) নিরাভাব হয়েছে এবং সুসংবাদ প্রাপ্ত হয়েছে। আর যারা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তারা বিলুপ্ত ও অভাবী হয়ে গেছে।
৯২. হে লোকসকল! যে মু’মিন মাওক্বিফে (আরাফাত, মা’শার ও মিনা) অবস্থান করে মহান আল্লাহ তার ঐ দিন পর্যন্ত কৃত গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। অতএব, তার (হাজী) উচিত হজ্ব সম্পন্ন হওয়ার পর সৎকর্ম পূনরায় করতে থাকা। হে লোকসকল! হাজ্বীরা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য প্রাপ্ত, তাদের সফর খরচের বদল প্রদান করা হবে। মহান আল্লাহ্ পুণ্যবানদের পুণ্যফল বিনষ্ট করেন না।
৯৩. হে লোকসকল! মহান আল্লাহর গৃহের হজ্ব করবে পরিপূর্ণ দ্বীন ও গভীর জ্ঞান নিয়ে। আর পবিত্র স্থানগুলো থেকে তওবা না করে এবং গুনাহসমূহ ত্যাগ না করে ফিরে এসো না।
৯৪. হে লোকসকল! নামায কায়েম করো এবং যাকাত দাও, যেভাবে মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, যদি দীর্ঘ সময় পার হয়ে যেয়ে থাকে এবং তোমরা তা পালনে অবহেলা করে থাকো অথবা ভুলে যেয়ে থাকো তাহলে (এ অবস্থায়) তোমাদের ওয়ালী হচ্ছে আলী এবং (সে) তোমাদের জন্য (কর্তব্য) বর্ণনাকারী; মহান আল্লাহ্ যাকে আমার পরে সৃষ্টিকূলের মাঝে নিজের আমীন (বিশ্বস্ত আমানতদার) এবং আমার স্থলাভিষিক্ত জানশীন বানিয়েছেন। নিশ্চয়ই সে আমার থেকে এবং আমিও তার থেকে। সে এবং আমার বংশধরদের মধ্য থেকে যারা ইমাম ও খলিফা হবে তাদেরকে যে বিষয়ে তোমরা জিজ্ঞেস করবে সে বিষয়ে তোমাদেরকে অবগত (করবে) এবং তোমরা যা জানো না তা তোমাদের কাছে বর্ণনা করবে।
৯৫. জেনে রাখো! নিশ্চয়ই হালাল ও হারামের সংখ্যা আমার গণনার উর্ধ্বে। আমাকে এই স্থানে সমস্ত হালাল ও হারাম বর্ণনা এবং তোমাদের থেকে বাইয়াত গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অতঃপর আমিরুল মু’মিনীন আলী এবং তার পরবর্তী ওয়াসীদের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা আনয়ন করেছি তা কবুল করা ও মেনে নেয়ার মাধ্যমে তোমাদের কাছ থেকে বাইআত গ্রহণের জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি। কেবল তাদের মধ্যেই ইমামতের ধারা বিদ্যমান থাকবে যার পরিসমাপ্তকারী হবে মাহদী, ঐ দিবস পর্যন্ত যখন সে (মাহদী) ক্বাযা ও ক্বদরের অধিপতি মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে।
৯৬. হে লোকসকল! তোমাদেরকে সকল হালালের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছি এবং প্রতিটি হারামের বিষয়ে নিষেধ করেছি। আর আমি তা থেকে প্রত্যাবর্তন করবো না এবং সেগুলোকে পরিবর্তনও করবো না। সুতরাং তোমরা তা স্মরণে রেখো, তা সংরক্ষণ করো এবং ঐ ব্যাপারে পরস্পরকে উপদেশ দিও। আর (ঐশী আহকামে) কোন পরিবর্তন করো না। তোমাদেরকে পূনরায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, তোমরা নামাজ কায়েম করো, যাকাত প্রদান করো, সৎকাজের নির্দেশ (দিও) এবং অসৎকাজে বাধা দিও।
৯৭. জেনে রেখো! সর্বশ্রেষ্ঠ আমর বিল মারুফ (সৎকাজের আদেশ) হল, যারা (এখানে) উপস্থিত নেই তাদের কাছে আমার এ বক্তব্য ও বাণী তোমরা পৌঁছে দেবে এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবূল করতে ও মেনে নিতে তাদেরকে আদেশ দেবে, পাশাপাশি এর বিরোধিতা করতে নিষেধ করবে; কারণ এটা হচ্ছে মহান আল্লাহ্ এবং আমার পক্ষ থেকে ফরমান ও আদেশ (স্বরূপ)। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ মাসুম (নিষ্পাপ) ইমামগণ ব্যতীত পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয় না।
৯৮. হে লোকসকল! পবিত্র কুরআন তোমাদের সম্মুখে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে যে, আলীর পরবর্তী ইমামগণ হচ্ছে তারই সন্তান। আর আমিও তাদের পরিচয় করিয়েছি তারা আমার ও তার (আলী) থেকে। যেভাবে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেছেন: ‘তিনি (আল্লাহ্) কথাটিকে (ইমামতকে) চিরন্তন আদর্শ ও তত্ত্ববাণী রূপে তার পরবর্তীদের জন্য রেখেছেন।’ [যুখরুফ : ২৮] আর আমি বলছি ‘যদি তোমরা এ দু’টোকে (পবিত্র কুরআন ও আহলে বাইত) আঁকড়ে ধরো তবে কখনই (সত্য থেকে) বিভ্রান্ত হবে না।
৯৯. হে লোকসকল! তাক্বওয়া! তাক্বওয়া! কেয়ামতের দিনের কষ্ট ও বিভীষিকা থেকে ভয় পাও যেভাবে মহান আল্লাহ্ বলেছেন: ‘নিঃসন্দেহে কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ানক ব্যাপার।’ [হজ্ব : ১]
১০০. স্মরণ করো মৃত্যু ও কেয়ামত, হিসাব ও মীজানসমূহ (আমলসমূহ মাপার যন্ত্র), জগৎসমূহের প্রতিপালকের সমীপে হিসাব-কিতাব এবং পুরস্কার ও শাস্তিকে। অতএব, যে ব্যক্তি সৎকর্ম নিয়ে আসবে সে তার বাবদ পুরস্কার পাবে। আর যে মন্দ কর্ম নিয়ে আসবে বেহেশত থেকে তার নসীবে কিছুই জুটবে না।
১১তম অংশ
১০১. হে লোকসকল! একই সময়ে এক হাতে বাইআত করার ক্ষেত্রে তোমাদের সংখ্যা অনেক বেশী। এ কারণে মহান আল্লাহ্ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমিরুল মুমিনীন আলী এবং তার পর আগত ইমামগণের -যারা আমার এবং তার থেকে- বিষয়ে যে অঙ্গীকার তোমরা করেছো সে বিষয়ে যেন তোমাদের মৌখিক সাক্ষ্য ও স্বীকারোক্তি গ্রহণ করি। কেননা আমি বলেছি আমার সন্তানরা তার (আলী) ঔরসজাত।
১০২. অতঃপর তোমরা সবাই বলো: আপনি আমাদের ও আপনার প্রভূর (মহান আল্লাহ) পক্ষ থেকে আমাদের ইমাম আমিরুল মুমিনীন আলী এবং তার ঔরসজাত ইমামদের ব্যাপারে যা প্রচার করেছেন তা আমরা শুনে আনুগত্য করছি এবং এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট আছি ও তা মেনে নিচ্ছি। এ বিষয়ে অঙ্গীকার করছি আমাদের হৃদয়, আমাদের জীবন-প্রাণ, আমাদের কণ্ঠ এবং আমাদের হাত (সবকিছু) দিয়ে তাদের জন্য আনুগত্যের প্রতীজ্ঞা করছি। আমরা এর উপরই জীবিত থাকবো, এর উপরই মরবো এবং এর উপরই আমাদেরকে (হাশরের দিনে) উত্তোলিত করা হবে। আমরা এতে কোন পরিবর্তন ও ওলট-পালট করবো না। না এ বিষয়ে কোন সন্দেহ পোষণ করবো, আর না এটা অস্বীকার করবো। আর এ অঙ্গীকার থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবো না। আমিরুল মু’মিনীন আলী এবং তার পরে তার ঔরসজাত আপনার বংশধরদের মধ্য থেকে ইমামগণ; যারা হচ্ছে হাসান, হুসাইন এবং তাদের দুজনের পরে যাদেরকে মহান আল্লাহ্ পাক ইমামতে অধিষ্ঠিত করেছেন তাদের সংক্রান্ত মহান আল্লাহর যে উপদেশ বাণী আছে তা দিয়ে আমাদেরকে আপনি নসিহত করেছেন। তাই আমাদের পক্ষ থেকে আমাদের হৃদয়, আমাদের জীবন-প্রাণ, আমাদের কণ্ঠ, আমাদের অন্তর এবং আমাদের হাত (আমার সমস্ত অস্তিত্ব) দিয়ে তাদের জন্য আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার গ্রহণ করা হল। যে ব্যক্তি (সশরীরে) নিজ হস্তে এই বাইআত আঞ্জাম দেবে ও করবে সে তা করলই, আর তা যদি না হয় তাহলে সে তা মুখে স্বীকার করে নেবে। আমরা কক্ষনো তার পরিবর্তন করবো না আর এ বিষয়ে মহান আল্লাহ আমাদের অন্তরে (নফসের) কোন পরিবর্তন দেখবেন না। আর আমরা এ বিষয়কে আপনার ভাষ্যের মাধ্যমে আমাদের কাছের এবং দূরের সকল সন্তানদের পৌঁছে দেব। আর আমরা এ বিষয়ে মহান আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি। আমাদের সাক্ষী হিসেবে মহান আল্লাহই যথেষ্ঠ এবং আপনিও আমাদের উপর সাক্ষী।
১০৩. হে লোকসকল! (এ বিষয়ে) তোমরা কি বলো? নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ সকল আওয়াজ শোনেন এবং প্রতিটি হৃদয়ের গুপ্ত রহস্য সম্পর্কে জানেন। ‘অতঃপর যে সৎপথ অবলম্বন করে, সে তা নিজেরই কল্যাণের জন্য করে এবং যে বিপথগামী হয়, সে তো বিপথগামী হয় নিজেরই ধ্বংসের জন্য।’ [যুমার : ৪১] আর যে ব্যক্তি বাইআত করবে মূলতঃ সে মহান আল্লাহর সাথে বাইআত করেছে, কেননা ‘আল্লাহর হাত রয়েছে তাদের হাতের উপর’। [ফাতহ : ১০]
১০৪. হে লোকসকল! অতএব, মহান আল্লাহর সাথে বাইআত করো, আমার সাথে বাইআত করো এবং বাইআত করো আমিরুল মুমিনীন আলী, হাসান ও হুসাইন এবং তাদের বংশধারায় আগত ইমামগণের সাথে যাদের ইমামত হলো দুনিয়া ও আখেরাতে চিরস্থায়ী আদর্শ ও তত্ত্ববাণী। মহান আল্লাহ্ বিশ্বাসঘাতককে ধ্বংস করে দেবেন। আর যে এ অঙ্গীকার রক্ষা করবে তার প্রতি অনুগ্রহ করবেন। ‘সুতরাং যে তা ভঙ্গ করে, তা ভঙ্গ করার পরিণাম তাকেই ভোগ করতে হবে এবং যে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার পূর্ণ করে, তিনি তাকে মহা পুরস্কার দেন।’ [যুমার : ১০]
১০৫. হে লোকসকল! যা কিছু আমি তোমাদেরকে বললাম তা তোমরা বলো। আলীকে তার ‘আমিরুল মুমিনীন’ উপাধী দিয়ে সম্বোধন করে সালাম করো, আর এখন বলো: ‘আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম! হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমার ক্ষমা চাই, আর তোমারই দিকে (আমাদের) প্রত্যাবর্তন হবে।’ [বাকারাহ : ২৮৫] বলো: ‘‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহরই; যিনি আমাদেরকে এর (হযরত আলীর ইমামত ও নেতৃত্বের) দিকে পরিচালিত করেছেন ও পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ আমাদেরকে পথ না দেখালে, আমরা কখনও পথ পেতাম না। নিশ্চয় আমাদের প্রতিপালকের রাসূলগণ সত্য (বাণী) এনেছিলেন।’ [আরাফ : ৪৩]
১০৬. হে লোকসকল! নিশ্চয়ই মহান আল্লাহর কাছে আলী ইবনে আবি তালিবের ফযিলতসমূহ যেগুলো তিনি পবিত্র কুরআনে অবতীর্ণ করেছেন সেগুলো এক মজলিসে (আসরে) বর্ণনা ও গণনা করার চেয়েও অনেক বেশী। অতএব, কেউ যদি তার ফজিলত সম্পর্কে তোমাদেরকে অবগত করে এবং সেগুলো চিনে থাকে তাহলে তার কথা সত্য মনে করো।
১০৭. হে লোকসকল! ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ও তার রাসুলকে আনুগত্য করবে’ [আহযাব : ৭১] এবং যে ব্যক্তি আলী ও যে সকল ইমামের কথা আমি তোমাদের কাছে উল্লেখ করেছি তাদেরকে আনুগত্য করবে ‘সে বিরাট বড় সাফল্য ও কামিয়াবি অর্জন করবে’। [আহযাব : ৭১]
১০৮. হে লোকসকল! তার বাইআত ও তাকে ভালবাসা এবং আমিরুল মুমিনীন খেতাব করে তাকে সালাম প্রদানে অগ্রগামীরা সফলকাম হবে এবং তারা নেয়ামতে পূর্ণ জান্নাতে প্রবেশ করবে।
১০৯. হে লোকসকল! এমন কথা বল যাতে মহান আল্লাহ খুশী হন। তোমরা এবং যমীনের সকল বাসিন্দাও যদি মহান আল্লাহকে অস্বীকার করো তাহলে তোমরা ‘কখনও আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’ [আলে ইমরান : ১৪৪]
১১০. হে আল্লাহ্! যা কিছু পৌঁছে দিয়েছি এবং আদেশ করেছি তা পালন করার কারণে মুমিনদেরকে তুমি ক্ষমা করে দাও এবং কাফের ও অস্বীকারকারীদের উপর তুমি অসন্তুষ্ট থেকো। ওয়াল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন (সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রভূ মহান আল্লাহর)।